একটি দেশ তখনই প্রকৃত গণতান্ত্রিক হয়, যখন সেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেই স্বাধীনতা আজ হুমকির মুখে। সাংবাদিকরা যদি ভয় পেয়ে সত্য বলা বন্ধ করে দেন, তাহলে সমাজের অসঙ্গতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস-সবই অন্ধকারে ঢেকে যাবে। তখন সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরও স্তব্ধ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে এই দেশের মাটি। তাদের মৃত্যু শুধু একটি পেশারই ক্ষতি নয়, এটি গণতন্ত্রের মৃত্যুকেও ইঙ্গিত করে। সত্যের সৈনিকদের রক্ষা করতে না পারলে একদিন আমরা সবাই নিঃশব্দে হারিয়ে যাব অন্ধকারের গহ্বরে।
চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতি উন্মোচন করতে গিয়ে চরম বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন দেশের সাংবাদিকরা। সত্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। কথায় কথায় সন্ত্রাসীরা তাঁদের দিচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি। এমনকি পুলিশ সদস্য বা অন্য সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে তলবও করা হচ্ছে।
সন্ত্রাসীদের কথা না মানলে অনেক ক্ষেত্রে নৃশংসভাবে হত্যাও করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। গত বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে উপর্যুপরি কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন মহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।
এক বছরে দেশে ৪৯৬ সাংবাদিক হয়রানির শিকার : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে গত জুলাইয়ের মধ্যে দেশে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন।
গত আগস্ট ধানমণ্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সাত মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বাধা ও হামলায় আহত হয়েছেন ২৭৪ জন সাংবাদিক।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত হয়েছেন। তবে, এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এইচআরএসএসের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ২০ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৩৪ জন ও গ্রেপ্তার হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিক। একই সময় ২২টি মামলায় ৯২ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। একই সময় সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর অধীনে দায়ের করা অন্তত ১৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১২ জন এবং অভিযুক্ত করা হয়েছে ২৩ জনকে। এ ছাড়া সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে অন্তত ১৭টি হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২৭ জন সাংবাদিক
নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ১৫ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন পাঁচজন এবং লাঞ্ছিত হয়েছেন পাঁচজন। এ ছাড়া দুই মামলায় দুজন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট থেকে গত জুন পর্যন্ত ১৬৫ জন সাংবাদিক হামলা ও নাজেহালের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আহত হয়েছেন ৯৫ জন, লাঞ্ছিত হয়েছেন ৩২ জন, আক্রমণ করা হয়েছে পাঁচজনকে, হুমকি দেওয়া হয়েছে ২২ জনকে এবং মামলার আসামি করা হয়েছে ১১ জনকে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, মামলা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে ১৯৬টি। এর মধ্যে পাবনা সদর উপজেলার চরতারাপুর ইউনিয়নের দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার সুজানগর প্রতিনিধি সাংবাদিক মনিরুজ্জামান হামলার শিকার হন। গত বছরের অক্টোবরে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে হামলার শিকার হন দৈনিক কালবেলার রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর মাহমুদ। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়।
আরো যাঁরা হত্যার শিকার : পুলিশ ও স্বজনদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১০ অক্টোবর দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিমকে বাসায় ঢুকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১২ অক্টোবর ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় বাড়ির সামনে তারাকান্দা প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি স্বপন কুমার ভদ্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৭ আগস্ট রাতে হাতিরঝিল থেকে পুলিশ ও স্থানীয়রা উদ্ধার করে সাংবাদিক রাহনুমা সারাহর লাশ। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পৌর মেয়র, ইটভাটার মালিক, অজ্ঞাত মোবাইল থেকে ফোন করে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে সাংবাদিকদের। এ ছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসীদের নির্যাতন, অপহরণ ও বোমা হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যের মাধ্যমেও নির্যাতন ও হুমকির শিকার হচ্ছেন তাঁরা।
ঘুষের সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিককে পিবিআইয়ের তলব : বাংলা ট্রিবিউনের রূপগঞ্জ প্রতিনিধি লিখন রাজকে ঘুষসংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের প্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদেরজন্য তলব করেছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। লিখন রাজ বলেন, তাঁর কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ৪ আগস্ট পিবিআই নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল রাশেদের স্বাক্ষরে জারিকৃত নোটিশ অনুযায়ী, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের স্বার্থে’ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। নোটিশ প্রাপ্তির দুই কর্মদিবসের মধ্যে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে উপস্থিত হতে হবে এবং অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে পরিদর্শক মিন্টু কুমারের নাম সেখানে উল্লেখ রয়েছে। পিবিআই নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোস্তফা কামালরাশেদ জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, সাংবাদিক কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সূত্র কী ছিল ও তথ্যের উৎস নির্ভরযোগ্য কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যই এই নোটিশ। এটি কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে নয়, বরং তথ্য যাচাইয়ের অংশ। গত ৩ আগস্ট বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হাফিজুর রহমান একটি মামলার বাদীর কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। গত ২ আগস্ট এসংক্রান্ত একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে, যা ঘিরে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনার প্রেক্ষিতে ৩ আগস্ট পিবিআই সদর দপ্তর থেকে হাফিজুর রহমানকে সাময়িক
বরখাস্ত করা হয়। তবে সেই বরখাস্তের তথ্য গণমাধ্যমকে জানানো হয় গত ৪ আগস্ট।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (স্পেশাল ক্রাইম) মো. আশিক সাঈদ বলেন, ‘আমরা আমাদের তরফ থেকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যখনই কোথাও কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে আমরা খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। গাজীপুরে একজন সাংবাদিককে হত্যার ঘটনার তদন্ত চলছে। অবশ্যই তাঁকে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যা দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হামলা।
নোয়াবের উদ্বেগ : গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদের সই করা বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে গণমাধ্যম ও তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে চিত্র ফুটেউঠেছে, তা দুঃখজনক। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা নিয়ে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, সেখানে তথ্য প্রকাশ, মত প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হবে বলে নোয়াব আশা করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত এক বছরে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সংবাদপত্র কিংবা গণমাধ্যমে ‘মব’ সৃষ্টি করে মালিকপক্ষকে হুমকি, ভয়ভীতি দেখানোর সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত আরো মজবুত করবে।